রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা
জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার ৭ বছর অতিক্রান্ত। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এই দিনে জামায়াত শিবিরের সহিংসতায় আইন প্রয়োগকারি সংস্থার সদস্য ও সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ৫০ জন জখম হয়। হত্যা করা হয় সাতক্ষীরা সিটি কলেজের প্রভাষক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবিএম মামুন হোসেনকে। জেলা জুড়ে ৮০টি আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
এসব ঘটনায় মামলা হলেও মূল আসামীরা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অথচ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষরা সাত বছরেও ভুলতে পারেনি সেই দিনকার দুর্বিসহ স্মৃতি। সাতক্ষীরা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল খায়ের সরদার ও বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা মকবুল হোসেন বলেন, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের দিন ধার্য করার ফলে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত শিবির দেশব্যাপি হরতালের ডাক দেয়।
সে অনুযায়ি ওইদিন সকাল সাড়ে আটটায় জামায়াত নেতারা সাতক্ষীরা শহরতলীর কদমতলায় হরতালের পক্ষে সশস্ত্র সমাবেশ করে। রায় যাই হোক না কেন ওই দিন বিকেল তিনটায় কদমতলায় সকল নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সশস্ত্র অবস্থায় জড়ো হওয়ার জন্য ঘোষণা দেন কমপক্ষে ৫০টি নাশকতা মামলার পলাতক আসামী পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড জামায়াত নেতা ফিংড়ি ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান, জেলা জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারী জেনারেল আজিজুর রহমান,সদর উপজেলা জামায়াতের আমীর রফিকুল ইসলাম, সদর পশ্চিম থানা আমীর মাওলানা শাহাদাৎ হোসেন, কাশেমপুর হাজামপাড়া জামে সমজিদের ইমাম মোহাম্মদ আলী ও কাশেমপুর গ্রামের মাওলানা ঈমান আলীসহ জেলা জামায়াতের নেতৃবৃন্দ।

কাছে থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন জেলা জামায়াতের আমীর যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামী অধ্যক্ষ খালেক মন্ডল। তারা আরো বলেন, দুপুর একটা ৪০ মিনিটে দেলাওয়ার হোসাইনের ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে জামায়াতের ১০ হাজারের বেশি নারী, পুরুষ ও শিশু কদমতলায় সমবেত হয়। মিছিল থেকে সাতক্ষীরা শহর ঘেরাও করার ডাক দেওয়া হয়। সশস্ত্র মিছিলটি সাতক্ষীরা শহর অভিমুখে রওনা হওয়ার আগেই কতর্ব্যরত গোয়েন্দা (ডিএসবি বর্তমানে কোর্ট পুলিশ) পুলিশের সদস্য রিয়াজউদ্দিন, সাংবাদিক আহাদ হোসেনসহ কয়েকজনকে পিটিয়ে জখম করা হয়। ভাঙচুর করা হয় কদমতলা বাজারের ২০টির বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
মিছিলটি শুরু হওয়ার পর সার্কিট হাউজ মোড়ে পৌঁছানোর আগেই রাস্তার দু’ধারের কমপক্ষে ৩০টি বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়। বোমা হামলায় আহত হন সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগকারিদের সঙ্গে থেকে প্রতিরোধকারি পুলিশ, বিজিবি, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ মানুষের ভিডিও চিত্র ধারণের কাজে ব্যস্ত ছিলেন ইটাগাছার আয়েনউদ্দিন মহিলা আলিম মাদ্রাসার শিক্ষক, জামায়াত নেতা আবু সাঈদ বিশ্বাস। সার্কিট হাউজ মোড়ে পুলিশ ও বিজিবি’র বাঁধা পেয়ে তারা সার্কিট হাউজ ভাঙচুর করার চেষ্টা করলে বিজিবি’র গুলিতে মারা যায় পাঁচজন। পুলিশের পক্ষ থেকে পাঁচজনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করা হয়।
মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে জেলার সকল উপজেলায় হামলা শুরু করে জামায়াত শিবিরের নেতা কর্মীরা। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে কাশেমপুরের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবিএম মামুন হোসেনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে জামায়াত শিবিরের নেতা কর্মীরা। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা অ্যাড.মুস্তাফা লুৎফুল্লাহ, শ্রমীক লীগ নেতা সাইফুল করিম সাবু, সৈনিক লীগ নেতা আমজাদ হোসেন শোভনসহ কয়েকজন মামুনকে বাড়ি থেকে এনে সদর হাসপাতালে ভর্তি করে বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
সন্ধ্যার পরপরই সাতক্ষীরা সদর, কালীগঞ্জ, আশাশুনি ও শ্যামনগরে ৩০টির বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান , বাড়ি, ক্লাব ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ ও বিজিবির উপর হামলা চালানো হয়। দিনভর সহিংসতায় জেলা জুড়ে কমপক্ষে ৫০ জন জখম হয়। এসব ঘটনায় পুলিশ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে নয়টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় ১৪ হাজার জামায়াত শিবিরের নেতা কর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে আরো কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনায় আরো ছয়টি মামলা দায়ের করা হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, এসব মামলার এজাহার নামীয় আসামীদের অধিকাংশ রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ফলে ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত শিবির জেলা জুড়ে সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এমনকি অনেক আসামীদের প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। ওইসব আসামীদের জামিন করাতে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা মোটা অংকের টাকা নিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মী হিসেবে বা ভাল লোক বলে প্রত্যয়ন দিয়ে সহায়তা করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এদের মধ্যে জামায়াতের অর্থ যোগানদাতা সানি খালেকের পক্ষে জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ পর্যায়ের নেতাসহ কয়েকজন প্রত্যায়ন দিয়েছেন। ঝাউডাঙার এক জামায়াত নেতাকে আওয়ামী লীগ হিসেবে প্রত্যায়ন দিয়ে হাইকোর্টের কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন তৎকালিন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করার আগে ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতা ও পুলিশকে ম্যানেজ করে অনেকেই পার পেয়ে গেছেন। কৌশলে আওয়ামী লীগ নেতাদের ম্যানেজ করে কর্মী সমর্থক হয়ে বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশও নিয়েছেন কয়েকজন।
সাতক্ষীরা জর্জ কোর্টের অতিরিক্ত পিপি অ্যাড, ফাহিমুল হক কিসলু জানান, সদরের ছাত্রলীগ নেতা এবিএম মামুন হত্যা মামলায় চার্জশীটভুক্ত ২০১ জন আসামীর মধ্যে ৪০ জন পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে পত্রিকা বিজ্ঞপ্তির কপি দাখিলের জন্য দিন ধার্য আছে। একই উপজেলার সাতানী গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন হত্যা মামলায় ২০১৫ সালের পহেলা ডিসেম্বর এজাহারভুক্ত ২৬জন ও গ্রেপ্তারকৃত এক জনের বিরুদ্ধে চুড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ায় মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।
আমতলা গ্রামের এজাহার আলী হত্যা মামলায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি বাদির জেরা ও জবানবন্দি শেষ হয়েছে। কালীগঞ্জের রঘুনাথপুরের রুহুল আমিন হত্যা মামলায় চার্জশীট ভুক্ত ১০৭ জনের বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়েছে। একই উপজেলার চাঁচাই গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মোসলেম আলী মোড়ল হত্যা মামলায় সম্পুরক চার্জশীটে ৩০ জনের মধ্যে একজন পলাতক রয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতে পত্রিকা বিজ্ঞপ্তির কপি জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
ভাড়াসিমলার মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন হত্যা মামলায় পলাতকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিলের জন্য দিন আছে। কলারোয়ার গাজনা গ্রামের জজ আলী হত্যা মামলায় চার্জশীটভুক্ত ২৭ জনের মধ্যে ১৩জন পলাতক রয়েছে। ২২ মার্চ অভিযোগ গঠণের জন্য দিন ধার্য আছে। একই উপজেলার মাহাবুবর রহমান বাবু হত্যা মামলায় প্রথমটি চুড়ান্ত প্রতিবেদন শেষে ওই মামলার বাদিসহ ২৯ জনের মধ্যে পলাতক ৫ জনের বিরুদ্ধে আমলী আদালত -৪ এ ২৯ মার্চ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির দিন ধার্য আছে।
একই উপজেলার গোপীনাথপুরের আজাহারুল ইসলাম হত্যা মামলায় চার্জশীটভুক্ত ২৬ জন আসামীর মধ্যে ২ জন পলাতক রয়েছে। ১২ এপ্রিল অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে চার্জ গঠণের দিন ধার্য আছে। দেয়াড়া গ্রামের রবিউল ইসলাম হত্যা মামলায় চার্জশীটভুক্ত ৪২ জনের মধ্যে পাঁচজন পলাতক রয়েছে। আমলী আদালত-৪ এ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিলের জন্য দিন ধার্য আছে। সদরের তেতুলতলার আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল হত্যা মামলার ২৮ জনের মধ্যে ২ জন পলাতক রয়েছে।
বিচারের জন্য অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে পত্রিকা বিজ্ঞপ্তির কপি জমা দিতে বলা হয়েছে। সদরের শিয়ালডাঙার সামছুর রহমান হত্যা মামলায় চার্জশীটভুক্ত ১৮ জনের মধ্যে ২ জন পলাতক রয়েছে। আগামি ৯ জুন অভিযোগ গঠণের জন্য দিন আছে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে। দেবহাটার পাঁচপোতা গ্রামে আব্দুল আজিজ হত্যা মামলায় চার্জশীটভুক্ত ১৪ জনের মধ্যে চারজন পলাতক রয়েছে।
আমলী আদালত ৭ এ প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির কপি প্রাপ্তির জন্য দিন ধার্য আছে। একই উপজেলার পারুলিয়ার আলমগীর হোসেন হত্যা মামলায় চার্জশীটভুক্ত ৩৯ জনের বিরুদ্ধে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে অভিযোগ গঠণ করা হয়েছে। দক্ষিণ পারুলিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা আবু রায়হান হত্যা মামলায় ৭৩জন চার্জশীটভুক্ত আসামীর মধ্যে ১০ জন পলাতক রয়েছে। বিজ্ঞ আমলী আদালত- ৭ এ পলাতকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিলের জন্য দিন ধার্য আছে।