প্রতি রবিবারের বিশেষ প্রতিবেদন- পর্ব-১৩
শরিয়তউল্লাহ শুভ
সদ্য খোলা ফেসবুকের পাতা স্ক্রল করছিল তিথি (ছদ্মনাম)। হঠাৎ একটি মেসেজ আসে, “যার যার প্রোফাইল পিকটা এত সুন্দর না জানি সে কত সুন্দর”। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া তিথি কিছুটা অবাক হয়ে যায়।
আরে বাহ!! ফেসুবক অ্যাকাউন্ট খুলতে না খুলতেই এমন মেসেজ। পাল্টা উত্তর দিতে দিতে অজানা ঐ যুবকের সাথে কথা চলতে থাকে তার। প্রথমে বেশ কিছুদিন চলে সুন্দর সুন্দর কথাবার্তা। এরপর শুরু হয় ছবি দেওয়া নেওয়া।
একের পর একটা ছবি। আরো একটা ছবি। তারপর আরো একটা। কিন্তু এভাবে শুধু ছবিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বন্ধুত্ব, শুরু হয় দেখা করার প্রস্তাব। ছেলেটিকে খারাপ মনে হয়নি তিথির। দেখা করা যেতেই পারে। তবুও কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায় সে।
তবে ফেসবুকের বন্ধুটির যেন তর সইছিল না। মিষ্টি কথায় মন ভূলিয়ে তিথিকে যশোরের খড়কী এলাকার এক জনশূণ্য স্থানে নিয়ে যায় সে। সেখানে আগে থেকে ঠিক করে রাখা ঐ যুবকের আরো কয়েজন বন্ধু ছিল। তিথি তখন বুঝতে পারে কতবড় ভূল সে করেছে। তখন কিছু করার ছিল না তার। যৌন হেনস্থা করার জন্য তিথিকে জোরপূর্বক মাদক সেবন করায় তারা।
এরপর তাকে ৫ জন পালাক্রমে ধর্ষণ করে। ১২ বছর বয়সী এই তিথি অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে অসুস্থ অবস্থায় শহরের লোন অফিসপাড়ায় সন্ত্রাসী ভাগ্নে হৃদয়ের বাড়িতে দিয়ে আসে ধর্ষণকারীরা। সেখানেও ভাগ্নে হৃদয়সহ আরো ৪ জন রাতভর তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এতে করে আরো বেশী অসুস্থ হয়ে পড়ে সে।
পরেরদিন সকালে তিথির শারিরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে অসুস্থ তিথিকে হাসপাতালে ভর্তি করে পালিয়ে আসে তারা। এ ঘটনায় যশোর কোতয়ালী মডেল থানায় মামলা দায়ের করে তিথির পরিবার। মামলাটি গুরুত্বের সাথে আমলে নেয় পুলিশ। এরপর যশোর কোতয়ালী থানা পুলিশ ও যশোর ডিবি পুলিশ তদন্ত শুরু করে।
তিথির দেওয়া বর্ণনা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাথমিকভাবে আসামীদেরকে শনাক্ত করে পুলিশ। জানতে পারে তিথির সাথে ফেসবুকে পরিচয় হওয়া বন্ধুটির নাম পুষ্প। তার বাড়ি শহরের শংকরপুর গোলপাতা মসজিদ এলাকায়। তার বয়স মাত্র ১৫ বছর।
খড়কী এলাকায় প্রথমে তিথিকে ধর্ষণ করে পুষ্পর বন্ধু রায়হান, শাকিল, রবিউল ও শাহদিয়া। এরা সবাই সমবয়সী। তিথি অসুস্থ হয়ে পড়লে শহরের লোন অফিসপাড়ার ভাগ্নে হৃদয়ের ভাড়াবাসায় নিয়ে দ্বিতীয় দফায় ধর্ষণ করে পুষ্প, ভাগ্নে হৃদয়, ভাগ্নে মামুন ও ন্যাটা মামুন।
মামলাটি প্রায় দুই মাস ধরে তদন্ত করে পুলিশ। এরপর চলতি বছরের ২ জানুয়ারি ভোরে মামলার প্রধান আসামি পুষ্পকে খুলনার সোনাডাঙ্গা থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী পরদিন রাতে গোপালগঞ্জ ও খড়কি এলাকা থেকে রায়হান ও শাকিলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আসামীদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই মাদক সেবনসহ নানা অপরাধের অভিযোগ ছিল পুলিশের কাছে।
পরবর্তীতে আসামীদেরকে কারাগারে পাঠনোর আদেশ দেয় আদালত। শেষ খবর পর্যন্ত আসামীরা কারাগারেই আছে। ঘটনাটি ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের। এরকম ঘটনা কিন্তু এবারই প্রথম নয়। বছরজুড়ে ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুদের দ্বারা নানাভাবে হেনস্থার শিকার হচ্ছে অনেকেই। তবুও আমরা সচেতন হচ্ছি না।
যেমন সচেতন হয়নি চৌগাছার স্কুলছাত্রী লিমা (ছদ্মনাম)। ৯ম শ্রেণীতে উঠে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলে লিমা। ফেসবুকে সাগর আহমেদ নামের একটি আইডির সাথে বন্ধুত্ব হয়। ছেলেটিকে খুব ভালো লেগেছিল তার। অনেক সুন্দর করে কথা বলে। অনেক সুন্দর সুন্দর পোজ দিয়ে ছবি শেয়ার করে।
সব মিলিয়ে ছেলেটিকে খুবই ভালোবেসে ফেলে সে চলতে থাকে তাদের এই প্রেমের সম্পর্ক। ফেসবুকে প্রেমের দুইমাস হতেই প্রেমিক সাগর ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে লিমাকে দেখা করার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে রাজি হয় লিমা। দেখা করার জন্য পূর্ব নির্ধারিত উপজেলার জগদীশপুর তুলাবীজ বর্ধন খামারে যায়।
সেখানে তারা কথা বলতে থাকে। কথাবার্তা বলার এক পর্যায়ে তাকে ফুসলিয়ে সাগর ও তার একজন বন্ধু একটি কালো প্রাইভেটকারে তুলে নেয়। গাড়ির মধ্যেই লিমাকে ধর্ষণ করে সাগর। এরপর সজীবও তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে লিমা চিৎকার করতে থাকে। তার চিৎকারে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয় তারা।
এসময় হুমকি দিয়ে বলে এই ধর্ষণের ঘটনা তারা ভিডিও করে রেখেছে। কাউকে জানালে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হবে। বাড়ি এসে লিমা বিষয়টি তার পিতা-মাতাকে জানায়। পরদিন লিমার বাবা মা চৌগাছা থানায় একটি ধর্ষণ মামলা করে। পুলিশ এর পরদিন ধর্ষক সাগর ও তার সহযোগীকে আটক করে।
এঘটনায় আসামীদেরকে আদালতে নেওয়া হলে তারা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। পরে আদালত তাদেরকে কারা হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। দুইটি ঘটনার লক্ষনীয় বিষয় হল বর্তমানের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মন্দপ্রভাব। আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটা জিনিসেরই ভালো মন্দ দুটিই আছে।
আগুনে যেমন রান্না করা যায় তেমনি হাতও পোড়ে। তাহলে কি দোষ আমরা আগুনকে দিব ? নাকি দোষ হল মানুষের অসাবধানতার। উপরোক্ত ঘটনাগুলোও ঠিক একই রকম।
৭ম শ্রেণীতে পড়ুয়া তিথি কি আদৌ ফেসবুক ব্যবহারের উপযুক্ত ছিল ? কিংবা ৯ম শ্রেণীতে পড়ুয়া লিমা বাড়ি থেকে বের হয়ে ফেসবুকের প্রেমিকের সাথে নির্জন স্থানে দেখা করার কোন আবশ্যকতা ছিল?
পাশাপাশি তিথির ধর্ষণকারীরা তো সকলেই ছিল ১৫-১৮ বছর বয়সী। মাদক এবং ধর্ষনের মত অপরাধের সাথে তারা কিভাবে জড়িয়ে গেল? লিমার ধর্ষণকারীই মনে মনে ধর্ষনের চিন্তা কেন করলো ? এসকল প্রশ্নের দুইটা উত্তর।
প্রথমত আমাদের অসাবধানতা। আর দ্বিতীয়ত সমাজিক অবক্ষয়। আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি আসামীদেরকে তাদের অভিভাবকরা কখনো চোখে চোখে রাখেনি। খারাপ সঙ্গ, অতিরিক্ত আবেগ, ইন্টারনেট জুড়ে কুরুচিকর পর্ণ ভিডিওর ছড়াছড়ি বর্তমানে এসকল আপত্তিকর ঘটনার জন্য দায়ী। দৈনিক প্রজন্মের ভাবনার প্রতি রবিবারের এই আয়োজন “অপরাধ ডায়েরীর” এই পর্বটি হয়ত উঠতি বয়সী অনেকেই পড়ছেন।
অথবা এমন অনেকেই পড়ছেন যাদের ঘরে উঠতি বয়সীর ছেলে বা মেয়ে আছে। “টীম অপরাধ ডায়েরী” তাদের উদ্দেশ্যে বলছে, সদা সর্বদা ও সচেতন হোন। আবেগকে কমিয়ে কঠিন বাস্তবতাকে সামনে রেখে জীবন যুদ্ধে নামতে হয়।
যদি নিজের সামান্যতম একটি ভূলের জন্য কোন বিপদ হয় তবে সেটির জন্য সারাজীবন আফসোস করতে হবে। খারাপ সঙ্গ হতে দূরে থাকতে হবে। ইন্টারনেটের সৎ ব্যবহার জানতে হবে। ভ্যার্চুয়াল জগতের এসব বন্ধুদের থেকে বাস্তব জীবনের বন্ধুদেরকে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে।
এ ধরনের অপরাধে অভিযুক্ত বা ভিকটীম হিসেবে আমাদের স্বজনেরা কেও যাতে পুলিশ ফাইলসে স্থান না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাই নিজে সতর্ক হোন, অন্যকে সতর্ক করুন। সতর্কতাই রুখে দিক সকল অপরাধ।